প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের বিবরন দাও। বা কি কারনে, ভারতের কোথায়, কোথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের বিবরন দাও। বা কি কারনে, ভারতের কোথায়, কোথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠে?

ভূমিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতীয় জনজীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই যুদ্ধের বা বাবদ মেমন ভারতের অর্থ সম্পদ ব্রিটিশ সরকার ব্যবহার করেছিল, তেমনি যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহনের জন্য ভারতের জনসম্পদকে ও ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধশেষে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কভার বৃদ্ধি, বেকারত্ব, সেনাবাহিনী থেকে ছাঁটাই ইত্যাদি কাবনে ভারতের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, বুশ বিপ্লবের প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। বিপ্লববাদ নতুন করে জেগে ওঠে।

হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসােসিয়েশন (RA) : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষতঃ রুশ বিপ্লবের প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ভারতে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে। পশ্চিম ভারতে এই রকমই একটি সংগঠন ছিল ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসােসিয়েশন ১৯২৪ খ্রিঃ) ভারতে এক সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তােলা ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যরা বৈপ্লবিক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল এবং অর্থসংগ্রহের জন্য উত্তর প্রদেশের কাকোরি স্টেশনে রেল ডাকাতি করেছিল (১৯২৫ খ্রিঃ)। সরকার ও এই আন্দোলন দমন করতে তৎপর ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করে সরকার কাকোরি যড়যন্ত্র মামলা শুরু করে (১৯২৫ খ্রিঃ)। বাম প্রসাদ বিসমিল (প্রতিষ্ঠাতা)। আসফাক উল্লাহ ও অন্য ৪জন বিপ্লবীর মাসী এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড ও নির্বাসন দন্ড দেয় (১৯২৭ খ্রিঃ)।
এই শান্তি সত্বেও হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসােসিয়েশন নিষ্ক্রিয় না হয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরােধীতা প্রবল হয়ে ওঠে। চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে এই সংগঠনের নতুন নাম রাখা হয় হিন্দু্থান সােসালিস্ট রিপাবলিকান এসােসিয়েশন (HSRA) (১৯২৮ খ্রিঃ) ভগৎসিং রাজগুরু, সুখদেব প্রমুখ বিপ্লবী এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। ইতিপূর্বে সাইমন কমিশন বিরােধী বিক্ষোভের সময় পাঞ্জাবের পুলিশ কমিশনার স্যান্ডার্স মিছিলের উপর পুলিশকে লাঠি চালনার জন্য ভগৎ সিং স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন।

এই শান্তি সত্বেও হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসােসিয়েশন নিষ্কিয় না হয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজতানত্রিক ভাবধারা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরােধীতা প্রবল হয়ে ওঠে। চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে এই সংগঠনের নতুন নাম রাখা হয় হিন্দুস্থান সােসালিস্ট রিপাবলিকান এসােসিয়েশন (//SR) (১৯২৮ খ্রিঃ) ভগৎসিং রাজগুর, সুখদেব প্রমুখ বিপ্লবী এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন।

ইতিপুর্বে সাইমন কমিশন বিরােধী বিক্ষোভের সময় পাবের পুলিশ কমিশনার স্যান্ডার্স মিছিলের উপর পুলিশকে লাঠি চালনার হুকুম দিয়েছিলেন, লাঠির আঘাতেই লালা লাজপত রায়ের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার প্রতিশােধের জন্য ভগৎ সিং স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন। ভগৎ সি ও বটুকেশবর দত্ত জননিরাপত্তা বিলের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় আইন সভায় বােমা নিক্ষেপ করেন (১৯২৯, এপ্রিল) এবং বিপ্লবী ভাবাদশ প্রচারের জন্য স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হন। সরকার লাহাের ষড়যন্ত্র মামলা চালু করে (১৯২৯ খ্রিঃ) ভগৎ সিং, রাজগুর, সুখদেবকে ফাসী দেয়। এই মামলার অন্যতম আসামী যতীন দাস রাজবন্দীদের উপযুক্ত মর্যাদার দাবীতে ৬৪ দিন অনশন করে প্রানত্যাগ করেন। ভারতীয় জনজীবনে তার প্রভাব পড়ে।

ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (IR/) ও পশ্চিম ভারতের মতাে বাংলাদেশেও বৈপ্লবিক তৎপরতা শুরু হয়। ১৯২২ খ্রিস্টান্দে অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর বাংলার বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে এক গােপন সভা করেছিল। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সথানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক সূর্যসেন (মাষ্টারদা) চট্টগ্রামে তরুন বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। অস্তরশস্ত্র কেনার জন্য কয়েকটি ডাকাতি করে।

বিপ্লবীরা অর্থ সংগ্রহ করে। ব্রিটিশ পুলিশ এই সব ঘটনার জন্য সন্দেহ ক্ৰমে সূর্যসেন কে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করে। অল্পকাল পর (১৯২৮ খ্রিঃ) সূর্যসেন কারামুর হয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আমি’ (IBA) নামে এক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তােলেন। তার সহযােগী ছিলেন প্রতিলতা ওয়াদেদ্দার, কল্পনা দত্ত, গনেশ ঘােষ, লােকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, জীবন ঘােষাল ও আরা অনেকে। তাদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুণ্ঠন করে অস্ত্র সংগ্রহ করা। চট্টগ্রামকে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। ব্রিটিশ রাজের

বিধে প্রকৃত যুৎ করা, আর ধারনা ছিল এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে চট্টগ্রামের যুদ্ধের অনুকরনে বহু যুদ্ধ ক্ষেত্র গড়ে উঠবে – যার মােকাবিলা করা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। চট্টগ্রাম অাগার লুণ্ঠন : এই উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আমি র সদস্যরা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল রাত্রি ১০টায় চট্টগ্রাম আ্াগার লুষ্ঠনের জন্য যাত্রা করে। তাঁরা যােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ এর তার কেটে দেয়। প্রীতিভ্রাতা ওয়াদ্দোরের নেতৃহে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরােপীয়ান ক্লাব আক্রমন করে। অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘােবের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম হাগার লুণ্ঠন করে কিন্তু প্রয়ােজনীয় গুলি নিতে ভুলে যায়। এর পর এক ইশতেহার জারী করে সূর্যসেন

ব্রিটিশ ব্রাজের বিবদধে যুব ঘােষনা ও বিপ্লবী প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। রাে?গয়ে বহাে বংস হওয়ার জন্য সরকার চট্টগ্রামের ঘটনার কথা জানতে পারেনি। চট্টগ্রাম বন্দরে নােঙর করা একটি হারে বেতর থেকে ঘটনার কথা জানানাে হলে সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী চট্টগ্রামে প্রবেশ করলে (২০শে এপ্রিল) বিপ্লর নিকর্তা জালালার পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী জালালাবাদ পাহাড় ঘিরে ফেললে বিপ্লবীরা গুলিবর্ষন শুরু করে (৪৪ শে এপ্রিল) সাগঞ্জে বিপ্লবীদের ১১জন ও সরকার পক্ষের ৬৪ জন নিহত হয়। সূর্যসেন ও অন্যান্য কয়েকজন যুখক্ষেত্র থেকে পালিয়ে কান। পরে বিরাসবাপ্রপ্তার হন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জানুয়ারী সূর্যসেনের ফাসী হয় এবং অন্যান্যদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। বেঙ্গল ভলান্টিয়াল দল (BV); বাংলার বিপ্লবীরা বেঙ্গল ভলান্টিয়াস’ নামে এক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এই দলের সদস্য

নিক ঢাকার পুলিশ ইনসপেক্টর জেনারেল লােম্যানকে গুলি করে হত্যা করেন (১৯৩০, আগস্ট)। এরপর এই দলের সদস্যরা

বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডি, আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দর ৮ই ডিসেম্বর বিনয় কৃষ্ণ বসু,যান। পরে বিপ্লবীরা সবাই গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জানুয়ারী সূর্যসেনের ফাসী হয় এবং অন্যান্যদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। বিনয় বেন্গাল উলান্টিয়াস দল (B.V); বাংলার বিপ্লবীরা ‘বেঞ্গল ডলানি্যাস’ নামে এক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এই দলের সদস্য | কৃষ্ণ বসু ঢাকার পুলিশ ইনসপেক্টর জেনারেল লােম্যানকে গুলি করে হত্যা করেন (১৯৩০, আগস্ট)। এরপর এই দলের সদস্যরা বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডি, আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৩০ থিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর বিনয় কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত নামে তিন বিপ্লবী রাইটার্স বিল্ডিং এ গিয়ে কারা বিভাগের অধ্যক্ষ ইনসপকটর জেনারেল সিম্পসন ও অন্য এক উচ্চ পদস্থ কমচারা শ্রেগকে গুলি করে হত্যা করেন। সংগে সংগে পুলিশ কর্তা টেগার্টের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী রাইটার্স বিল্ডিং ঘিরে ফেলে। ফলে দুই পক্ষে রাইটার্সের অলিন্দে গুলি বিনিময় শুরু হয়। পরাজয় বা গ্রেপ্তার নিশ্চিত জেনে বাদল গুপ্ত আত্মহত্যা করেন আর বিনয়

হাসপাতালে মারা যান। দীনেশকেফাসী দেওয়া হয়।

অন্যান্য স্থানে বিপ্লবীরা সক্রিয় ছিল। মেদিনীপুরের ম্যজিস্ট্রেট পেডিকে বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত গুলি করে হত্যা করেন (১৯৩১, ৭ই এপ্রিল)। ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কে বিপ্লবী প্রদ্যোত ভট্টাচাৰ্য (১৯৩২ খ্রিঃ) এবং ম্যাজিস্ট্রেট বার্জকে বিপ্লবী মৃগেন ও অনাথ বন্ধু গুলি করে হত্যা করেন (১৯৩৩ খ্রিঃ)। একই ভাবে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার আসানুল্লাকে বিপ্লবীরা গুলি করে হত্যা করে (১৯৩১ খ্রিঃ) ও বাংলার ছােটলাট জ্যাকসনকে বিপ্লবী ছাত্রী বীনাদাস হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেন (১৯৩২ খ্রিঃ)।

মূল্যায়ন ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে গড়ে ওঠা সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও প্রকৃতি আগের তুলনায় পরিবর্তিত হয়েছিল। ধর্মাশ্রয়ী চিন্তাভাবনার বদলে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধীতা এর প্রধান উপাদান ছিল। সংগঠিতভাবে আক্রমন এর বৈশিষ্ট্য ছিল। বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও তাদের কার্যকলাপ, চিন্তাধারা ভারতীয় জনমানসে শ্রধা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করে। তাদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ দেশবাসীর সামনে প্রেরনা সৃষ্টি করে। জালালাবাদের তিনদিনের অসম যুদ্ধ যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল ঘটনা, তেমনি রাইটার্স বিল্ডিং এর অভিযান ও দুঃসাহসিক ঘটনা। ব্রিটিশ আমলাদের হত্যাকাণ্ড যেমন সরকারকে শঙ্কিত করে তােলে, তেমনি দেশবাসীকে পুলকিত করে। এভাবে সশস্ত্র প্রতিবাদ ভারতীয়দের মানসিকতাকে উজ্জীবিত করে তােলে।

leave your comment

Categories

Hot Product

Top